কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : ১৬-০৩-২০২০
কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার ঘটনায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, সিনিয়র সহকারি কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন, সহকারি কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস.এম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ প্রশাসন-২শাখার সিনিয়র সহকারি সচিব শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিম(১৩১৫৮) কে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, কুড়িগ্রাম হিসেবে নিয়োগ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করার হবে। সোমবার ১৬মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এই কথা বলা হয়।
অপরদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব কে.এম আল আমীন স্বাক্ষরিত (১৫মার্চ) চিঠিতে পদায়নের জন্য সিনিয়র সহকারি কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন, সহকারি কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা, ও এস.এম রাহাতুল ইসলামকে (এনডিসি) রাস্ট্রপতির আদেশক্রমে পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: হাফিজুর রহমান।
আরিফুলের সর্বশেষ অবস্থা:
হাসপাতালের বেডে শুয়ে শারিরীক সমস্যা ও মানসিক যন্ত্রণায় সময় কাটছে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্টে নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের। অজানা আশংকা কাজ করছে তার ভেতরে। ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। পাশে রয়েছেন স্ত্রী ও দুইশিশু সন্তানসহ স্বজনরা। তারা সেবা শুশ্রƒষার পাশাপাশি যোগাচ্ছেন মানসিক শক্তি। চিকিৎসায় তার শারিরীক সমস্যার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক তার শারিরীক সুস্থতার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চালাচ্ছেন চিকিৎসা।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান জানান, রোববার হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওষুধপত্র খাওয়ার পর এখন কিছুটা শারিরীক উন্নতি হয়েছে তার। তিনি ধন্যবাদ জাপন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। পাশাপাশি তার নির্যাতনের ও জেল জরিমানার পর কুড়িগ্রামবাসী, সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
তার স্ত্রী নিতু জানান, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার স্বামীকে নির্যাতনকারী সকলের শাস্তি দাবি করেন। তার স্বামীর জন্য ন্যায় বিচার দাবী করেন। পাশাপাশি স্বামী সন্তানসহ তার পরিবারের নিরাপত্তার দাবি জানান।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আাবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. রেদওয়ান ফেরদৌস সজীব জানান, সাংবাদিক আরিফুলের ¯¦াস্থ্যগত সমস্যা আপাতত নেই। তার শারিরীক অবস্থা স্থিতিশীল।
এদিকে প্রত্যাহারের ঘটনা জানাজানির পর নিজের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান জানান, এই ঘটনায় রাষ্ট্র এবং প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি অবশ্যই তা মেনে নেই। রাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি আস্থাশীল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ন্যায় বিচার করবেন এটা আমার দৃঢ় বিশ^াস। আমি যেন ন্যায় বিচার পাই,আমি যেন আমার নিরাপত্তা পাই।
আরিফুলের ঘটনায় সংস্কৃতি কর্মী দুলাল বোস ও সাংবাদিক মাহফুজ টিউটর উদ্বুদ্ধ ঘটনায় প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহন করায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, যারা এই বিতর্কিত ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে তাদেরকে দৃষ্টানমূলক শাস্তিসহ আরিফুলের পরিবারকে যেন নিরাপত্তা দেয়া হয়। জেলা পর্যায়ের সর্ব্বোচ্চ কর্মকর্তারা যাতে ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে না পারে সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।
কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে সোমবার দুপুরে সচেতন ছাত্র ও যুব সমাজ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম যৌথভাবে এবং নাগেশ^রীতে নাগেশ^রী প্রেসক্লাব, প্রেসক্লাব নাগেশ^রী ও কচাকাটা প্রেসক্লাব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে যৌথভাবে মানববন্ধন করে।
এসময় বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক ছানালাল বকসি, শ্যামল ভৌমিক, বিএমএসএফ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসাইন, জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুর রহমান মমিন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সাকিব প্রমুখ।
মধ্যরাতে নাজিম উদ্দিনের আদালত:
কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের হোতা সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা, আসামীদের স্বজনদের মারধর এমনকি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের কর্মচারিদের মারধরসহ নানা ধরণের অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নাগেশ^রী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের দেবিপুর গ্রামে এক অভিযান চালিয়ে সরকারি বিলে মাছ চাষের অভিযোগে বিশ^নাথ ও বৃদ্ধ মজনু মিয়াকে ধরে এনে ২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন। এ সময় বিশ^নাথকে মারধর করলে তার কাকা কাকা বাবলু নমদাস প্রতিবাদ জানান। একারণে তাকে কিল, ঘুষি ও লাত্থি দেন কমিশনার নাজিম উদ্দিন। পরদিন মজনু মিয়া আদালত থেকে জামিন নিলেও বিশ^নাথের মামলার নথি নিতে গেলে গালিগালাজ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন তার স্বজনদের।
বিশ^নাথের কাকা বাবলু নমদাস বলেন, ‘নাজিম উদ্দিন স্যার আমাকে ২-৩টা লাত্থি দেন। আমি কয়েকদিন কাজ করতে পারিনি। এখনও ঠিকমত হাঁটতে পারিনা।’ বিশ^নাথের ছোটবোন সুখ বালা বলেন, আমরা মামলার নতি নিতে নাজিম উদ্দিন স্যারের কোর্টে গেলে পেশকার নথি দেয়নি। পরে স্যারের সাথে দেখা করে নথি চাইলে তিনি ক্ষেপে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। নথির অভাবে জামিনের আবেদন করতে পারছিনা আমরা। এমনকি ক্রস ফায়ারের হুমকি দিতেন।’
এছাড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার কর্মচারি নুর ইসলাম সরকারকে তুচ্ছ কারণে মারধর করেন নাজিম উদ্দিন। শাখার কর্মচারিরা জানান, তাকে ডিসি অফিসের বারান্দা থেকে কলার ধরে নিজ কক্ষে টিনে হেচরে নিয়ে যান। একাধিক কর্মচারি অভিযোগ করেন তুচ্ছ কারণে তিনি মোবাইল কোর্টের হুমকি দিতেন।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫০ জন তহশিলদার ও পিয়ন বদলীতে ২৫ থেকে ১ লাখ টাকা আদায় করেন। আবু বক্কর নামে তার দালালকে ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব সহকারী কামকম্পিউটার পদে সম্প্রতি চাকুরি দিয়েছেন। তার মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে জলমহাল ইজারা দিতেন। প্রয়োজনে লিজগ্রহীতার প্রতিপক্ষ লোকজনকে আটক করে মোবাইল কোর্টে সাজা দিতেন।