কুড়িগ্রাম :
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কৃষক আযাহার আলী মুন্সী। চলতি মৌসুমে চরের তিন বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছেন তিনি। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু বোরো আবাদের শেষ সময়ে এসে জমিতে সেচ দেয়ার তেল কিনতে পারছেন না তিনি। কারণ নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বন্ধ রয়েছে স্থানীয় সব হাটবাজার। তাই নিজের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। আবার নগদ টাকাও হাতে নেই, যা দিয়ে বোরো আবাদের খরচ মেটাতে পারেন। এ অবস্থায় এ কৃষিপণ্য বিক্রি করে বোরো সেচের ডিজেল, সার ও কীটনাশক কিনতে না পারায় চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি।শুধু আযাহার আল মুন্সীই নন, করোনার কারণে হাটবাজার বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় ঝুনকার চরের অসংখ্য বোরোচাষী।চাষীরা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ।
স্থানীয় সূত্রে গেছে, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার সহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় জেলার প্রায় চার শতাধিক চরা ল রয়েছে। এর বেশির ভাগ চরের প্রত্যক কৃষক এক থেকে পাঁচ বিঘা পর্যন্ত জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। চরা লের বোরো ক্ষেতে প্রতিদিন সেচ দিতে হয়। কৃষকের মধ্যে যাদের হাতে সি ত টাকা আছে, তারা কোনোভাবে বাজার থেকে তেল, সার ও কীটনাশক জোগাড় করে বোরো ক্ষেত টিকিয়ে রেখেছেন। আর যাদের হাতে গচ্ছিত টাকা নেই, তারা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় ঠিকমতো জমিতে সেচ দিতে পারছেন না।
কৃষক আযাহার আলী মুন্সী বলেন, দেশব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় হাটবাজার বন্ধ রয়েছে। এজন্য গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ধান, চাল, কাউন, চীনাবাদাম, তিল, তিসিসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে চরে উৎপাদিত ফসল হাটবাজারে বিক্রি করতে পারছি না। তাই টাকার অভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী জমিতে সেচ দেয়ার ডিজেলও কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার আমাদের এ ঝুনকার চরে কমপক্ষে ৫০টি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচ মেশিন আছে। এসব শ্যালো মেশিনে প্রায় ৩৫০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। চরের প্রত্যক পরিবারই কম-বেশি বোরো আবাদ করেছে। আমাদের চরের সব কৃষক নৌকা নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন (শনিবার আর মঙ্গলবার) যাত্রাপুর হাটে গিয়ে নিজেদের পোষা গবাদিপশু বা উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে ডিজেল, সার, কীটনাশকসহ বাড়ির প্রয়োজনীয় খরচ করি। এখন সেই হাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা চরের মানুষরা অনেক সমস্যায় পড়েছি। খাবার-তরিতরকারির ব্যবস্থা কোনো রকমে করতে পারলেও জমিতে সেচ দেয়ার ডিজেল, সার ও কীটনাশক কিনতে পারছি না। হাতে টাকা থাকলে কোনো উপায় করে কেনা যেত কিন্তু কোনো কিছু বিক্রি না করলে তো টাকা আসে না। এখন এ অবস্থা কতদিন চলবে বুঝতে পারছি না। সেচ দিতে না পারলে চরের আবাদ পুড়ে যাবে।
পার্শ্ববর্তী চর বড়ুয়া রলাকাটার কৃষক মঈনুদ্দিন জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিদিন সেচ দিতে এক লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। পরপর দুই দিন পানি দিতে না পারলেই বালি জমি ফেটে যায়। হাটবাজার বন্ধ থাকায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না চরা লের বেশির ভাগ কৃষক। এ অবস্থায় তিনি ধারদেনা করে ডিজেল, সার ও কীটনাশক কিনে বোরো ক্ষেত টিকিয়ে রেখেছেন।
একই কথা জানান ঝুনকার চর ও রলাকাটার চরের বোরোচাষী কৃষক কেরামত আলী, আছির উদ্দিন সরকার ও হাবিবুর রহমান।
কৃড়িগ্রাম কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার নদ-নদীর অববাহিকায় ২৩০টি চরে ২৯ হাজার ৮২৪ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ২২২টি চরের ২২ হাজার ৫৪৯ হেক্টর জমি আবাদযোগ্য। কৃষকরা সেখানে ধান, ভুট্টা, চীনাবাদাম, মরিচ, গম, কাউন, তিল, কলাসহ বিভিন্ন রকম ফসল চাষ করেন।চলতি বোরো মৌসুমে চরাগুলোয় কী পরিমাণ জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজার রহমান তার কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, জেলার নয়টি উপজেলায়ই কম-বেশি চর রয়েছে। চরে বোরো আবাদের হিসাব উপজেলা কৃষি অফিসগুলোয় আছে।চরা লের বোরোচাষীদের ডিজেল, সার ও কীটনাশক নিশ্চিত করতে কৃষি বিভাগ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে হঠাৎ করেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ডিজেল, সার ও কীটনাশকের দোকানগুলো কৃষকদের সুবিধার জন্য খোলা আছে।করোনা পরিস্থিতিতে জেলার হাটবাজারগুলো বন্ধ থাকায় চরা লের বেশির ভাগ কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে বোরো আবাদের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিষয়টি আপনার মাধ্যমে আমি অবগত হলাম। কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য দ্রুতই কৃষি বিভাগের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।