ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে৷ আইএমএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি চার শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার৷ সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার৷ অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে৷

স্বাভাবিক ভাবেই আইএমএফ-এর এই রিপোর্ট নিয়ে ভারত জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করে বলেছেন, পাঁচ বছর আগেও যেখানে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি ছিল, সেখানে আইএমএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যেতে পারে৷ মোদী সরকারের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার এটাই সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷

যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে 
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ার পর দ্রুত বিকাশের জন্য বাংলাদেশকে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে সুযোগ ছিল সবকিছু নতুন করে শুরু করার। তবে লড়াইটা সহজ ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রথম প্রতিবেদনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য এখানে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, এখনো তা ৫০ বছরের নিচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’

গবেষকেরাও খুব সদয় ছিলেন না বাংলাদেশের প্রতি। যেমন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ে তাঁরা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’

ভারত কেন পিছিয়ে
বাংলাদেশ যেভাবে আগাচ্ছে আর ভারত কেন পিছিয়ে—এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দেওয়া হচ্ছে নানা ব্যাখ্যা। ভারতের গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ভারতের পিছিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি কারণের কথা বলেছে।
১. ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। তবে এ সময়ে ভারত এগিয়েছে আরও দ্রুত গতিতে। আর এই প্রবণতা বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ব্যবধান কমেনি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া শ্লথ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে আগের চেয়েও দ্রুততার। সঙ্গে এর প্রভাব পড়েছে জিডিপির মাথাপিছু হিসাবে।

২. গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল কম, ভারতের বেড়েছে অনেক বেশি হারে। যেমন ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর একই সময়ে বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আমরা জানি, জিডিপিকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই মাথাপিছু জিডিপির হিসাব পাওয়া যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তারতম্যের কারণেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান এমনিতেই কমে আসছিল। অথচ ২০০৭ সালেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। আর যদি ২০০৪ সালের হিসাব নেওয়া হয়, তাহলে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এই ব্যবধান গত কয়েক বছরে দ্রুত কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। আর কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

৩. কোভিড-১৯-এর প্রভাব দুই দেশের জন্য সমান হয়নি। মহামারির এ সময়ে অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। যেমন আইএমএফের হিসাবে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হবে বলেই এর প্রভাব পড়ছে মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে।