শিরোনাম

6/recent/ticker-posts

জেনে নিন কেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১ সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল


১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যেখানে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হলো যে প্রধান সেনাপতি অফিসারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। সেনা কমান্ডকে সমন্বিত করে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ বাহিনীতে প্রশিক্ষণার্থীদের বাছাইপর্বে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এরপর জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সার্বিক পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে যুদ্ধ-অঞ্চল (সেক্টর) গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং এই লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়োজনের জন্য কর্নেল ওসমানীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর ১০ থেকে ১৭ জুলাই কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সেই সম্মেলনে বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হবে, কে কোন সেক্টরের কমান্ডার হবেন, কয়টি ব্রিগেড তৈরি হবে ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ ও সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ও যুদ্ধকৌশল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

সেখানে কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব সেনা প্রধান, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার উপ-প্রধান এবং মেজর এ আর চৌধুরী অতিরিক্ত উপ-প্রধান নিযুক্ত হন।

এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। দশম সেক্টরটি সর্বাধিনায়কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এই সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো বাহিনী এবং সর্বাধিনায়কের বিশেষ বাহিনী। পাশাপাশি প্রতিটি সেক্টরকে অঞ্চলভেদে ভাগ করা হয় কয়েকটি সাব-সেক্টরে।

এক নজরে ১১ সেক্টর এবং সেক্টর কমান্ডার

সেক্টর নং ১

ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি এবং ফেনী পর্যন্ত ছিল ‘সেক্টর নং ১’। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। আর এই সেক্টরকে পাঁচটি সাব সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল।

সেক্টর নং ২

ঢাকা, কুমিল্লা, আখাউড়া-ভৈরব, নোয়াখালী ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘সেক্টর নং ২’। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার। এই সেক্টরে ৬টি সাব সেক্টর ছিল।

সেক্টর নং ৩

হবিগঞ্জ, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্ব দিকে কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষ এবং কিশোরগঞ্জ ও ঢাকার কিছু অংশ ছিল ‘সেক্টর নং ৩’ এর আওতায়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কেএম শফিউল্লাহ। পাশাপাশি সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এর সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মেজর এএনএম নুরুজ্জামান। আর এই সেক্টরে ছিল ৭টি সাব-সেক্টর।

সেক্টর নং ৪

সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘সেক্টর নং ৪’। এই সেক্টরেও ছিল ৬টি সাব-সেক্টর। মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সিআর দত্ত (পরে মেজর জেনারেল) এবং পরে ছিলেন ক্যাপ্টেন এ রব।

সেক্টর নং ৫

বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ‘সেক্টর নং ৫‘ গঠিত হয়। মেজর মীর শওকত আলী ছিলেন এই সেক্টরের কমান্ডার। এই সেক্টরকেও ছয়টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল।

সেক্টর নং ৬

দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহাকুমা এবং ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রংপুর নিয়ে গঠিত হয় ‘সেক্টর নং ৬’। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এমকে বাশার। এই সেক্টরে ছিল পাঁচটি সাব-সেক্টর।

সেক্টর নং ৭

রাজশাহী, পাবনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী এলাকা ব্যতীত সমগ্র বগুড়া, দিনাজপুরের দক্ষিণ অঞ্চল এবং রংপুরের কিছু অংশ ছিল ‘সেক্টর নং ৭’ এর অন্তর্ভুক্ত। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তিনজন- মেজর নাজমুল হক, সুবেদার মেজর এ রব ও মেজর (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) কাজী নুরুজ্জামান। এই সেক্টরে ছিল নয়টি সাব-সেক্টর।

সেক্টর নং ৮

কুষ্টিয়া, যশোর, দৌলতপুর সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত খুলনা জেলা ও ফরিদপুরের কিছু অংশ ছিল ‘সেক্টর নং ৮’ এর অন্তর্ভুক্ত। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) আবু ওসমান চৌধুরী ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুর। এই সেক্টরে ছিল সাতটি সাব-সেক্টর।

সেক্টর নং ৯

পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় ‘সেক্টর নং ৯’। ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল এবং তারপর মেজর জয়নাল আবেদীন। এছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ মঞ্জুর। এই সেক্টরে ছিল তিনটি সাব-সেক্টর।

সেক্টর নং ১০

সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, নৌ কমান্ডো ও আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ছিল ‘সেক্টর নং ১০’ এর অধীনে। এ সেক্টরে নৌ কমান্ডোরা যখন যে সেক্টরে মিশনে নিয়োজিত থাকতেন, তখন সে সেক্টরের কমান্ডারের নির্দেশে কাজ করতেন। এই সেক্টরে কোনো সাব-সেক্টর ছিল না এবং ছিল না নিয়মিত কোনো সেক্টর কমান্ডার। প্রধান সেনাপতির নিয়ন্ত্রণাধীন বিশেষ বাহিনী ছিল এটি।

সেক্টর নং ১১

কিশোরগঞ্জ বাদে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে গঠিত হয় ‘সেক্টর নং ১১’। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। নভেম্বর পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু তাহের ও তারপর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (পরবর্তীতে উইং কমান্ডার) এম হামিদুল্লাহ খান। এই সেক্টরকে সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল।