
ঘটনার পটভূমি ২০২৫ সালের ৮ মার্চ বিকেলে আধিপত্য বিস্তার ও বালু ব্যবসার বিরোধকে কেন্দ্র করে এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদারবাড়ি এলাকায় প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় চার ভাইকে। নিহতরা হলেন- আতাউর রহমান সরদার (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৩৩), পলাশ সরদার (১৮) ও তাজেল (১৮)। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সশস্ত্র হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে এলাকার নারী-শিশুসহ শত শত মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নিহতদের পরিবার দাবি করে, পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষরা তাদের পুরুষ সদস্যদের খুন করেছে যাতে বালু ব্যবসা ও রাজনৈতিক প্রভাব নিজেদের হাতে রাখা যায়।
মামলা ও তদন্ত নিহত আতাউর ও সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে মাদারীপুর সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৪৯ জনকে নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় এবং অজ্ঞাত আরও ৮০ থেকে ৯০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার পর থেকেই স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক ছিলেন। তবে পরবর্তীতে র্যাব-৮ ও র্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে মামলার প্রধান আসামি কৃষক দলের নেতা শাহজাহান খানকে ঢাকার হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই অভিযানে শাহজাহানের সহযোগী সায়েদ মোল্লাকেও আটক করে র্যাব। এছাড়াও পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় কুলসুম বেগম, সুজন মাহমুদ ও রুবেল ব্যাপারীসহ আরও কয়েকজনকে। কিন্তু মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিদের বেশিরভাগই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে বলে নিহতদের পরিবার অভিযোগ করছে। হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর খোয়াজপুর ইউনিয়নে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে অনেক পুরুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, ফলে গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছিল।
খুন হওয়া তিন পরিবারের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টানা কয়েকদিন এলাকা টহল দেয়। ঘটনাটি শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ, মামলার আসামিদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। জামিনে মুক্ত আসামি আমির সরদার আবারও আলোচনায় তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও নতুন করে আলোচনায় আসে মামলার ৮ নম্বর আসামি আমির সরদার। তিনি মান্নান সরদারের ছেলে ও এলাকার একটি প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। মামলার পর আমির সরদার সুপ্রিম কোর্ট থেকে ৪২ দিনের সাময়িক জামিন নেন। কিন্তু স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তার জামিনের মেয়াদ চার মাস আগে শেষ হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আসামিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হয় কিংবা পুলিশের তাকে গ্রেপ্তার করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। বরং আমির সরদারকে প্রকাশ্যে এলাকায় চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতার কারণে তিনি এখন প্রকাশ্যে চষে বেড়াচ্ছেন এবং প্রভাব খাটাচ্ছেন। নিহত পরিবার ও এলাকাবাসীর ক্ষোভ নিহতদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের গাফিলতির কারণেই আমির সরদার গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
সুফিয়া বেগম বলেন, আমার চার কলিজার টুকরাকে দিনের আলোতে কুপিয়ে মেরে ফেলল। আজ পর্যন্ত আমরা ন্যায়বিচার পেলাম না। বরং আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর অপমান। স্থানীয়রা বলেন- জামিনের মেয়াদ শেষ হলেও আমির সরদারকে গ্রেপ্তার না করা আইনের প্রতি অবমাননা। তাঁরা দাবি করেন, দ্রুত তাকে আইনের আওতায় আনা না হলে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। প্রশাসনের অবস্থান এই বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)-কে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্বীকার করেন যে আমির সরদারের জামিনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে তিনি জানান- তার তদন্ত চলছে। আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগোচ্ছি। এ অবস্থায় এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছেন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করছে কেন? নিহতদের পরিবার বলছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী হওয়ায় আমির সরদার এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। আইন ও মানবাধিকারকর্মীদের মতামত স্থানীয় আইনজীবীরা বলছেন, জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো আসামির মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করা বেআইনি।
পুলিশ চাইলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করতে পারে। একজন মানবাধিকারকর্মী মন্তব্য করেন,ষ- এই ঘটনাটি প্রমাণ করে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এখনও প্রভাবশালীদের জন্য আলাদা সুযোগ রয়েছে। এটা শুধু নিহত পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি হুমকি। মাদারীপুরের চার খুনের ঘটনা শুধু চারটি পরিবারকেই ধ্বংস করেনি, বরং গোটা এলাকায় আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও আসামিদের প্রতি শিথিল মনোভাব বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে। নিহত পরিবারসহ এলাকাবাসী এখন একটাই দাবি জানাচ্ছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক- সকল আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক।