পার্কের উন্নয়ন চলতে চলতে শিশুরাই বড় হয়ে গেছে!

আরমান হোসেন 

একসময় শিশুদের কলকাকলিতে মুখর ছিল শাহবাগের শিশুপার্ক। এই পার্কের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। হয়তো এ কারণেই ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকার পার্কটির এই হাল করেছে।

একসময় শিশুদের কলকাকলিতে মুখর ছিল শাহবাগের শিশুপার্ক। এই পার্কের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। হয়তো এ কারণেই ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকার পার্কটির এই হাল করেছে।

ঈদ আনন্দ, ছুটির দিন কিংবা যেকোনো অবসর সন্তানদের নিয়ে নাগরিকরা ছুটতেন রাজধানীর শাহবাগ শিশুপার্কে। কিন্তু সাত বছর ধরে বন্ধ থাকায় সেই পার্কে শিশুদের হাসি আর কলতান, রাইডিংয়ের উচ্ছ্বাস ও হাওয়াই মিঠাইয়ের গন্ধ এখন কেবলই স্মৃতি। আধুনিকায়নের বেড়াজালে সবার দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেছে এই ঐতিহ্যবাহী শিশুবিনোদন কেন্দ্রটি।

শিশুপার্কের আধুনিকায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প। এছাড়া দরপত্রজট, দখল এবং প্রশাসনিক ধীরগতির কারণে রাজধানীর এই ঐতিহ্যবাহী পার্কের আধুনিকায়ন প্রকল্পে সৃষ্টি হয়েছে বহুমাত্রিক জটিলতা।

প্রসঙ্গত, শাহবাগের শিশুপার্কটি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীনে গড়ে ওঠে। ১৫ একর জমিতে গড়া পার্কটি ১৯৮৩ সালে ঢাকার মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরিত হয়। তখন এর নাম ছিল ‘ঢাকা শিশুপার্ক’। পরে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘শহীদ জিয়া শিশুপার্ক’। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এ নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ফের ‘শহীদ জিয়া শিশুপার্ক’ নাম পুনঃনিশ্চিত করা হয়। উন্নয়ন শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণা করা হবে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর এই শিশুপার্ক বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয় ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পের কাজ। এর আওতায় পার্কের নিচে ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং, জলাধার, আন্ডারপাস, হাঁটার পথ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ ছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। তবে সময়সীমা শেষ হলেও কাজ শেষ হয়নি।

পরবর্তীতে ২০২৩ সালে শিশুপার্ক আধুনিকায়নের জন্য ডিএসসিসি নতুন প্রকল্প নেয়। একনেক অনুমোদিত ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয় মানের আধুনিক রাইড ও অবকাঠামোর মাধ্যমে পার্কটিকে নতুন করে সাজানো। তবে প্রকল্প গ্রহণের পর প্রায় দুই বছর পার হলেও কাজ তেমন এগোয়নি। এ অবস্থায় মেয়াদ বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে করপোরেশন।

কাজ পুরোদমে করতে পারছে না ডিএসসিসি

সরেজমিন দেখা গেছে, শিশুপার্ক আধুনিকায়ন প্রকল্প মাত্র ৪৫ শতাংশ এলাকায় কাজ করছে। সম্পূর্ণ জায়গা না পাওয়ায় কাজ পুরোদমে শুরু করতে পারছে না ডিএসসিসি। শাহবাগ মোড়ের কাছাকাছি ফুল মার্কেট ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের লালবাগ ডিভিশনের ডাম্পিং স্পট থাকায় এখানে অহরহ ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এসব সরাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার চিঠি পাঠালেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া শাহবাগ মোড়ে অবস্থিত পরিত্যক্ত তিনতলা ভবন ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেমিপাকা ভবনও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে।

এরই মধ্যে পার্কের উত্তর-পশ্চিম পাশ দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান ও বিএনপির ইউনিটের অস্থায়ী অফিস। ফলে আরসিসি ড্রেন ও এরিয়া-২ প্লাজা নির্মাণের কাজ আটকে আছে। নির্মাণাধীন এলাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই গাঁজা ও ইয়াবা সেবনকারীদের আনাগোনা বাড়ে। তাদের আড্ডার জন্য বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকানও। এছাড়া এরিয়া-১ ও এরিয়া-২-এ পুরনো রাইড, পরিত্যক্ত টয়লেট, ব্যাংক ভবন, পাম্প হাউস ও থানার অংশ থাকায় মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে না।

বর্তমানে কয়েকটি পুরনো রাইড পার্কে পড়ে আছে। আগে শিশুপার্কে ছিল ১১টি রাইড, নতুন প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে ১৫টি ইউরোপীয় মানের আধুনিক রাইড; যাতে একসঙ্গে প্রায় ৬০০ শিশু বিনোদন উপভোগ করতে পারবে। এসব রাইডের মধ্যে রয়েছে ডিস্ক ও মেগা-৪০, সুপার এয়ার রেস, টি কাপ-৯, ফ্লাইং ক্যারোসেল, এনডেভার, গ্যালিয়ন, ১২ডি থিয়েটার, মাইন কোস্টার ক্লাইম্বিং কার, বাম্পার কার ম্যাজিক বাইকস ট্রাম্পোলিন বেড, সুপার হ্যাপি সুইং, মেরি গো রাউন্ড ও ওয়াটার ম্যানিয়া।

মতামতের জন্য আটকে আছে দরপত্র আহ্বান

প্রকল্পের শুরুতেই রাইডগুলোর মূল্য অতিরিক্ত ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ডিএসসিসি স্পেসিফিকেশন পুনঃপর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়। দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্য যাচাইয়ের জন্য পত্র পাঠানো হয়।

ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আনিসুর রহমান বতমান সময়ের বাংলাদেশকে বলেন প্রকল্প অনুমোদনের আগে একনেকের কারিগরি ও মূল্য যাচাই কমিটিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই অনুমোদন দেয়। পরে বিতর্ক ওঠায় রাইডগুলোর অনুমোদিত কারিগরি নির্দেশ ও দর পুনঃপর্যালোচনার জন্য বুয়েট ডুয়েট, এমআইএসটি আহ্‌ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইইউটির মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পেলেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।

জানা গেছে, রাইড যাচাইয়ের জন্য বুয়েটের বিআরটিসি যে ফি চাইছে, তা পরিশোধে ডিএসসিসি বেকায়দায় রয়েছে। কারণ প্রকল্প প্রণয়নের সময় এমন ব্যয়ের ধারা রাখা হয়নি। এজন্য তুলনামূলক কম খরচে যাচাই করতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে, যা দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব ঘটাচ্ছে।

বড়দের মর্জিতে শিশুপার্ক সংস্কার

প্রকৌশল বিভাগের হিসাব অনুযায়ী অফিস ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ৩৫ শতাংশ সীমানাপ্রাচীর, ওয়াকওয়ে ও জনসুবিধা উন্নয়ন ৩০ শতাংশ; প্লাজা, পানি সরবরাহ ও ড্রেনেজ ২০ শতাংশ; ফোয়ারা ও পানিপ্রবাহ ব্যবস্থা ৪০ শতাংশ; আর ইনটেরিয়র সাজসজ্জা ও ইনডোর বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পন্ন হয়েছে ১৫ শতাংশ। বহিরাঙ্গন বিদ্যুৎ সংযোগ ও বাগান আলোকায়নের জন্য তিনবার টেন্ডার ব্যর্থ হয়ে চতুর্থবার নতুন আহ্বান করা হয়েছে। পার্ক উন্নয়ন শেষ হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে প্রবেশ করতে হবে শাহবাগ দিক থেকে প্রবেশের পথ আর থাকবে না।

এ ব্যাপারে বড়দের মর্জিতে শিশুপার্ক সংস্কার এমন মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের নামে শিশুপার্ক বন্ধ মানে নিম্নবিত্তের বিনোদনস্থান বন্ধ করে উচ্চবিত্তের ভোগের জন্য নতুন জায়গা তৈরি করা। জনগণের সম্পদ গুটিকয় মানুষের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া উচিত নয়।