বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের মুখের ভাষা বাংলা। ১৩শ’ বছরেরও বেশি প্রাচীন এক মহান ভাষার উত্তরাধিকারী আমরা। শুধু উত্তরাধিকারীই নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য সংগ্রাম করে তাজা প্রাণ পরম মমতায় আর উদ্ধত বিপ্লবে বিলিয়ে দিয়ে সেই পথ বেয়ে ভাষার অধিকার আদায় তো করেছিই তার পাশাপাশি জাতিগত ও ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জনের মহাকাব্যও রচনা করেছিলেন আমাদের পূর্ব প্রজন্ম।
ভাষার অধিকার এবং শুদ্ধ বাংলা চর্চার গুরুত্ব :
সাগর সমান রক্তের স্রোত পেরিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সত্তর বছরপূর্তি হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ও শফিউর রহমানসহ নাম না জানা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের ভাষার অর্জন শুধু গৌরবের নয়, অবিস্মরণীয়ও বটে। এই আত্মত্যাগ আর দাবির ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হয় এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ তরান্বিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয় বাংলাকে।
ভাষা হিসেবে বাংলা প্রাচীন মাগধী থেকে আরও বিস্তৃত, মিশ্রিত ও গভীর হয়ে দূর কালের সাথে বর্তমান কালের আর বহুদেশের অজানা চিত্তের সঙ্গে বাংলাদেশের নবজাগ্রত চিত্তের মিলনের দৌত্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। নানা রূপ, রস আর ছন্দে বাংলা ভাষা পেয়েছে সমৃদ্ধি, আপন শক্তিতে বিকশিত হয়েছে। বিকাশের এই ধারায় বাংলা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিজাতি ভাষার আগ্রাসনে। ভাষার বিকৃতি নানা সময়ে আমাদের গর্বের বাংলাকে দীপ্তিহীন করতে চেয়েছে এবং এখনো যার সমাপ্তিরেখা টানা যায়নি; অথচ এর সম্ভাব্য ও প্রমাণিত পরিণতি সুদূরপ্রসারী।
মানভাষা- রবীন্দ্রনাথ যাকে প্রাকৃত ভাষা বলেছেন সেই শুদ্ধ বাংলার চর্চায় আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। ফলে, না পারছি মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা করতে, আর না পারছি বিদেশি ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করতে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করে। আর অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা থেকে সীমাহীনভাবে উপকৃত হয় মাতৃভাষা। শুদ্ধ ভাষা চর্চা, শুদ্ধ চেতনাকে জাগিয়ে তোলে এবং শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর দিয়েই একটি জাতি যেমন এগিয়ে যেতে পারে, তেমনি আরেকটি জাতিকেও এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে।’ এসব বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, শত সংগ্রাম আর ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিমেয়ে অর্জিত বাংলা আজ গভীর সংকটের মুখে। বাংলা-ইংলিশের সংমিশ্রণে বাংলিশ কিংবা প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে বিকৃত রূপের বাংলা চর্চার থাবায় বাংলা ভাষার প্রকৃত স্বাদ যেন বিস্বাদে পরিণত হচ্ছে।
শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা :
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। গণমাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা বেতার শুধু খবর জানা বা প্রকাশের মাধ্যমই নয় বরং শিক্ষা এবং বিনোদনেরও মাধ্যম। আর তাই গণমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন ও বেতার মাধ্যমে প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা চর্চার মাধ্যমে একটি শুদ্ধ বা মান বাংলা ভাষার প্রসারের সুযোগ অতুলনীয়। দেশের কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত অধিকাংশ টেলিভিশন ও বেতারেই শুদ্ধ বাংলার চর্চা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে, সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তো এর বিকল্প নেই। আবার যাদের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলায় সংবাদ প্রচার করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুকরণীয় এবং আকর্ষণীয়ভাবে শুদ্ধ বাংলার চর্চা করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ।
বিকৃতিহীন ও প্রমিত বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাকগণ সবসময়ই আতসী কাঁচের নিচে থাকেন। উপস্থাপকমাত্রই শুধু তার নিয়োগকর্তা নয়, বরং হাজারো দর্শক-শ্রোতার সার্বক্ষণিক তীক্ষ্ম ও সূক্ষ্ম নজরদারি ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে সংবাদ উপস্থাপনা করে থাকেন। কোনো তথ্যগত ভুল কিংবা বিকৃত যেমন তার কাছ থেকে অগ্রহণযোগ্য হয়, তেমনি একটিমাত্র ভুল বা বিকৃত উচ্চারণও সংবাদ উপস্থাপকদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত নয়। প্রতিনিয়ত সঠিক শব্দের সঠিক উচ্চারণ এবং সঠিকভাবে প্রক্ষেপন সংবাদ উপস্থাপকদের একটি পেশাগত দায়বদ্ধতা। ‘আওভান’ কিংবা ‘কোরে’ অথবা ‘ফসলে’র মত বহুল ভুল উচ্চারণ হওয়ার সম্ভাবনাময় শব্দগুলোকে অবলীলায় বাকযন্ত্র ও প্রশ্বাসের সঠিক প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণ করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ। যে শব্দের উচ্চারণ যত জটিল, উপস্থাপকদের জন্য সেই শব্দের সঠিক চর্চা ও প্রক্ষেপণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর একারণেই শুদ্ধ বাংলা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকদের ভূমিকা অপরিসীম। এই পেশাগত দায় নিয়েই বছরের পর বছর সংবাদ উপস্থাপকগণ বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও শুদ্ধতম প্রসারে একনিষ্ঠ সাধক।
ভাষা হিসেবে বাংলা প্রাচীন মাগধী থেকে আরও বিস্তৃত, মিশ্রিত ও গভীর হয়ে দূর কালের সাথে বর্তমান কালের আর বহুদেশের অজানা চিত্তের সঙ্গে বাংলাদেশের নবজাগ্রত চিত্তের মিলনের দৌত্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। নানা রূপ, রস আর ছন্দে বাংলা ভাষা পেয়েছে সমৃদ্ধি, আপন শক্তিতে বিকশিত হয়েছে। বিকাশের এই ধারায় বাংলা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিজাতি ভাষার আগ্রাসনে। ভাষার বিকৃতি নানা সময়ে আমাদের গর্বের বাংলাকে দীপ্তিহীন করতে চেয়েছে এবং এখনো যার সমাপ্তিরেখা টানা যায়নি; অথচ এর সম্ভাব্য ও প্রমাণিত পরিণতি সুদূরপ্রসারী।
মানভাষা- রবীন্দ্রনাথ যাকে প্রাকৃত ভাষা বলেছেন সেই শুদ্ধ বাংলার চর্চায় আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। ফলে, না পারছি মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা করতে, আর না পারছি বিদেশি ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করতে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিত করে। আর অন্য ভাষার শুদ্ধ চর্চা থেকে সীমাহীনভাবে উপকৃত হয় মাতৃভাষা। শুদ্ধ ভাষা চর্চা, শুদ্ধ চেতনাকে জাগিয়ে তোলে এবং শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর দিয়েই একটি জাতি যেমন এগিয়ে যেতে পারে, তেমনি আরেকটি জাতিকেও এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করে।’ এসব বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, শত সংগ্রাম আর ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিমেয়ে অর্জিত বাংলা আজ গভীর সংকটের মুখে। বাংলা-ইংলিশের সংমিশ্রণে বাংলিশ কিংবা প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে বিকৃত রূপের বাংলা চর্চার থাবায় বাংলা ভাষার প্রকৃত স্বাদ যেন বিস্বাদে পরিণত হচ্ছে।
শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকের ভূমিকা :
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। গণমাধ্যম তথা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন কিংবা বেতার শুধু খবর জানা বা প্রকাশের মাধ্যমই নয় বরং শিক্ষা এবং বিনোদনেরও মাধ্যম। আর তাই গণমাধ্যমে বিশেষত টেলিভিশন ও বেতার মাধ্যমে প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা চর্চার মাধ্যমে একটি শুদ্ধ বা মান বাংলা ভাষার প্রসারের সুযোগ অতুলনীয়। দেশের কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত অধিকাংশ টেলিভিশন ও বেতারেই শুদ্ধ বাংলার চর্চা লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে, সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তো এর বিকল্প নেই। আবার যাদের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলায় সংবাদ প্রচার করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুকরণীয় এবং আকর্ষণীয়ভাবে শুদ্ধ বাংলার চর্চা করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ।
বিকৃতিহীন ও প্রমিত বাংলা ভাষা চর্চায় সংবাদ উপস্থাকগণ সবসময়ই আতসী কাঁচের নিচে থাকেন। উপস্থাপকমাত্রই শুধু তার নিয়োগকর্তা নয়, বরং হাজারো দর্শক-শ্রোতার সার্বক্ষণিক তীক্ষ্ম ও সূক্ষ্ম নজরদারি ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে সংবাদ উপস্থাপনা করে থাকেন। কোনো তথ্যগত ভুল কিংবা বিকৃত যেমন তার কাছ থেকে অগ্রহণযোগ্য হয়, তেমনি একটিমাত্র ভুল বা বিকৃত উচ্চারণও সংবাদ উপস্থাপকদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত নয়। প্রতিনিয়ত সঠিক শব্দের সঠিক উচ্চারণ এবং সঠিকভাবে প্রক্ষেপন সংবাদ উপস্থাপকদের একটি পেশাগত দায়বদ্ধতা। ‘আওভান’ কিংবা ‘কোরে’ অথবা ‘ফসলে’র মত বহুল ভুল উচ্চারণ হওয়ার সম্ভাবনাময় শব্দগুলোকে অবলীলায় বাকযন্ত্র ও প্রশ্বাসের সঠিক প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণ করে থাকেন সংবাদ উপস্থাপকগণ। যে শব্দের উচ্চারণ যত জটিল, উপস্থাপকদের জন্য সেই শব্দের সঠিক চর্চা ও প্রক্ষেপণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর একারণেই শুদ্ধ বাংলা চর্চায় সংবাদ উপস্থাপকদের ভূমিকা অপরিসীম। এই পেশাগত দায় নিয়েই বছরের পর বছর সংবাদ উপস্থাপকগণ বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও শুদ্ধতম প্রসারে একনিষ্ঠ সাধক।
প্রশ্ন আসতে পারে, সংবাদ উপস্থাপকগণ কি ভাষার বিকৃতি করেন না তাহলে? একদমই অস্বীকারের উপায় নেই, যে তা কদাচ হয় না বটে! তবে তা কোনোভাবেই তাদের মানস্থাপক নয়। বরং সংবাদ উপস্থাপকদের অনেকক্ষেত্রেই যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় কিংবা যেভাবে ‘লিখিত সংবাদ’ অটোকিউতে হুবহু পাঠ করার চর্চাগত একটি বাধ্যবাধকতা নির্দিষ্ট করা হয়, তা যেমন তাদের শব্দগত বা ভাষাগত বৈচিত্র প্রকাশের প্রতিবন্ধক, আবার অনেকক্ষেত্রেই তুলনামূলক অপ্রস্তুত অবস্থায়ও অনেককে উপস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন নাটক সিনেমা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমবাহিত ভাষা বিকৃতির যখন নতুন প্রজন্মের বৃহৎ একটি অংশ স্মার্টনেস প্রকাশের প্রত্যয় থেকে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণে জোশ, পিনিক, অসাম, মাগার, বিন্দাস, প্যারা, মাইরালা, খ্রাপ, সেইরাম, ভাল্লাগছে, আজিব, তার ছিঁড়া ইত্যাদি নানারকম অদ্ভুতুড়ে শব্দ বাংলা হিসেবেই ব্যবহার করছে, তখন এ ভাষায় হয়তো ভাব প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু ভাষার যে মাধুর্য কিংবা সুকুমারবৃত্তি তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে বাংলা ভাষায় বিকৃত শব্দসমষ্টির সমাহারের সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। ঠিক এখানেই আবার সংবাদ উপস্থাপকরা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই ভাষার শুদ্ধ চর্চা নিশ্চিতে অতন্দ্র প্রহরী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ইথারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। শহুরে আবাসিক থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত মান ভাষা পৌঁছে দেওয়া এবং মান ভাষার শিক্ষা লাভে সংবাদ উপস্থাপকরা অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। নানান প্রান্তের, নানা অঞ্চলের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মানুষ সংবাদ উপস্থাপকের উপস্থাপনা, উচ্চারণ ও শব্দের প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়েই মান বা শুদ্ধ বাংলা শিখে থাকে। স্থানীয় যেকোনো মানুষ সংবাদ উপস্থাপকের উপস্থাপিত শব্দ বা উচ্চারণের অনুকরণ করে মান ভাষা শিখতে পারেন।