মানবসৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত। ইবাদতের মর্মকথা হলো সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী সত্তার সামনে সর্বাধিক বিনীতভাবে নিজেকে সঁপে দেওয়া। আক্ষরিক অর্থে এটা সর্বতোভাবে সিজদার মাধ্যমে সম্ভব। মানবসৃষ্টির সূচনায় আদি পিতা আদম (আ.)-কে ‘কিবলা’ বানিয়ে সিজদা করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
সিজদা কখনোই আদম (আ.)-এর জন্য ইবাদত ছিল না। বরং তা ছিল মানবজাতির প্রতি অন্যদের সম্মান প্রদর্শন। আসলে সিজদা হলো আল্লাহর প্রাপ্য এবং আল্লাহর প্রতি যাবতীয় ইবাদতের শ্রেষ্ঠাংশ। মহান আল্লাহ মানুষকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গোটা সৃষ্টিজগৎ আল্লাহকে সিজদা করে
পৃথিবীর সব কিছুই মহান আল্লাহর জন্য সিজদা করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে এবং তাদের ছায়াসমূহও (সিজদা করে) সকালে ও সন্ধ্যায়—ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়।
সিজদা আল্লাহর জন্য :
পৃথিবীর সব কিছুই মহান আল্লাহর জন্য সিজদা করে। আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ- ‘আর আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে ও তাদের ছায়াসমূহ সকালে ও সন্ধ্যায় ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়’ (রা‘দ ১৩/১৫)।
‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ্কে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও বহু মানুষ। আর বহু মানুষ (যারা সিজদা করতে অস্বীকার করেছে) তাদের উপর শাস্তি অবধারিত হয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তাকে সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা চান তাই-ই করেন’ (হজ্জ ২২/১৮)। তিনি আরো বলেন,
‘তারা কি আল্লাহর সৃষ্ট বস্ত্তসমূহের প্রতি লক্ষ্য করে না। তাদের ছায়া ডাইনে ও বামে ঢলে পড়ে আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় বিনীতভাবে? আসমান ও যমীনে যত প্রাণী আছে, সবই আল্লাহকে সিজদা করে এবং ফেরেশতাগণ। আর তারা অহংকার করে না’ (নাহল ১৬/৪৮-৪৯)।
মানুষ ও জিনের মধ্যে যারা বিনয় ও আনুগত্যের সাথে আল্লাহকে সিজদা করে তারা বিশেষভাবে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوْا سُجَّدًا وَسَبَّحُوْا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُوْنَ- ‘কেবল তারাই আমার নিদর্শনগুলো বিশ্বাস করে, যাদেরকে তা স্মরণ করিয়ে দিলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে ও তাদের প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা কীর্তন করে এবং অহংকার করে না’ (সাজদা ৩২/১৫)।
তিনি আরো বলেন,أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ- ‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদায় কিংবা দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখেরাতকে ভয় করে ও তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান, যে তা করে না)’ (যুমার ৩৯/৯)।
আল্লাহ তা‘আলা কেবল মানব ও জিন জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তবে উপরে বর্ণিত সিজদা সংক্রান্ত আয়াতগুলি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর সকল সৃষ্টিই তাঁর ইবাদত করে। এমনকি জড় বস্ত্তগুলিও আল্লাহর পবিত্র মহিমা ঘোষণা করে, আল্লাহকে সিজদা করে। আল্লাহ বলেন, وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ ‘...তারকা ও বৃক্ষাদি সিজদারত আছে’ (আর-রহমান ৫৫/৬)।
সিজদা সংক্রান্ত উপরোক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে দেখা যায় যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবাই আল্লাহকে সিজদা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, মানুষের মধ্যে অনেকে তাঁকে সিজদা করে, আবার অনেকে সিজদা করে না। এদের সম্পর্কে দয়াময় আল্লাহ বলেন,فَرِيْقًا هَدَى وَفَرِيْقًا حَقَّ عَلَيْهِمُ الضَّلَالَةُ إِنَّهُمُ اتَّخَذُوا الشَّيَاطِيْنَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَيَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُوْنَ ‘এক দলকে আল্লাহ হেদায়াত নছীব করেছেন এবং আরেক দলের উপর ভ্রষ্টতা নির্ধারিত হয়ে গেছে। তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে এবং ভেবে নিয়েছে যে, তারা সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/৩০)।
এ পৃথিবী মানুষের জন্য একটা অসাধারণ ও কঠিন পরীক্ষা কেন্দ্র। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ- ‘মহিমাময় তিনি যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষার জন্য যে, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭/১-২)।
মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেওয়া হবে? আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী। যারা মন্দ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে? তাদের সিদ্ধান্ত কতই মন্দ!’ (আনকাবূত ২৯/২-৪)।