শিরোনাম

6/recent/ticker-posts

একুশে ফেব্রুয়ারি: ভাষা শহীদদের বীরগাথা এক ইতিহাস স্মরণের দিন


নিজস্ব প্রতিবেদক :

"একুশে ফেব্রুয়ারি" দিনটি কেনো আমাদের কাছে স্মরণীয়? কেনো আমরা দিনটিকে এতো আবেগের সাথে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর শুধু আমার জানা আছে এরকম না, আমি মনে করি প্রতিটি বাঙালির অন্তরে এ দিনটির গুরুত্ব, তাৎপর্য খোদাই করা আছে। আজ আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে যেভাবে কথা বলছি এটা আদায়ের ইতিহাসই হলো এই স্মরনীয় ফেব্রুয়ারি, এ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের বীর সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ বাংলা ভাষা।

আমরা স্বাধীনভাবে এখন আমাদের মাতৃভাষাতে কথা বলি এবং গর্বের সাথেই বলি, কারণ সারা বিশ্বের ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্র কখনো তাদের ভাষার রক্ষার্থে রক্ত দেইনি। বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রভাষা তার মাতৃভাষা রক্ষা করতে রক্ত দিয়েছে। তাই আমাদের বাংলা ভাষাতে কথা বলতে আমরা শুধু স্বাচ্ছন্দ বোধ করি তাই নয় বরং গর্বিত অনুভব করি। যারা এ গর্বের কারণ হয়েছে আছে আমাদের মনে-প্রাণে তাদেরকে এ জাতি সবসময় শ্রদ্ধা করবে। জাত-পাত, ধর্ম যে যেকোনো মতাদর্শই লালন করুক না কেন সবাই সবার যায়গা থেকে ভাষাশহীদদের এ ত্যাগকে শ্রদ্ধা করে। বাংলাদেশের মানুষের মনের মনিকোঠায় স্থান করে আছে একেকটা শহীদের স্মৃতি, তাদের রেখে যাওয়া স্লোগান "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চায়। "

ভাষা অর্জনের এ ইতিহাস সহজ ছিলো না। আমরা যতো সহজে যতো স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলছি এটা অর্জনের পথ সোজা ছিলো না। একটা জাতিকে পঙ্গু করতে চেয়েছিলো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা সে কারনেই তারা সর্বপ্রথম আমাদের ভাষার ওপর নজর দেয়। কারণ তারা ভেবেছিলো কোনো জাতির মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে পারলে তাদেরকে পরাধীন করার উপাই পেয়ে যাবে। এ কারণেই তারা সর্বপ্রথম আমাদের ভাষার ওপর কুনজর দিয়েছিলো, কেড়ে নিতে চেয়েছিলো আমাদের মুখের ভাষা বাংলাকে। তাই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত নিপীড়ন করতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে, বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে পুর্ব পাকিস্তান।

ভাষা আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম প্রতিবাদ গড়ে তোলে এবং ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররাই প্রতিবাদ মিছিল বের করে, যেখানে পুলিশ গুলি চালায় এবং সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন।

ছাত্রদের নেতৃত্বেই ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ ও মিছিল সংঘটিত হয়, যা সরকারকে বাংলা ভাষার দাবিতে চাপ দিতে বাধ্য করে। তাদের আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এই ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের সাফল্যই পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিলো।

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। শুধু দেশের মধ্যে না, দেশের বাইরেও বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এটা স্মরণীয়-বরণীয়। শহীদদের বীরগাথা এ ইতিহাসকে স্মরণ করেই শহীদ মিনার নির্মিত হয় এবং এই শহীদ মিনারই আমাদের ভাষা শহীদদের পরিচয় বহন করে যাচ্ছে এবং যতোদিন পর্যন্ত এ পৃথিবী থাকবে মানুষ তাদেরকে এভাবেই শ্রদ্ধা করে যাবে।

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় দেশের বিভিন্ন শহীদ মিনারে পুষ্প স্তবক অর্পণ। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সমস্ত ধর্ম-পেশার মানুষেরা যে যার জায়গা থেকে স্মরণ করে তাদের।

এ জাতি জানে রক্ত দিতে, এ জাতি জানে অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে। তারই বাস্তব প্রমাণ ফুটে উঠলো জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। হাজার হাজার ছাত্র তাদের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছে পারিবারিক মায়া ত্যাগ করে, শুধু একটা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। হাজারও মায়ের বুক খালি হলো আবারও, কারণ এ জাতি যে জানে অধিকার আদায়ের জন্য জীবনকে কিভাবে উৎসর্গ করতে হয়। এ শিক্ষা প্রতিটি বাংলাদেশি নিজের ভেতর লালন করে তাই তারা কোনো বৈষম্যকে কখনোই গ্রহণ করতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি এ আদর্শ আমরাদের প্রত্যেকের চেতনায় গাথা থাকবে এবং কখনো কোনো ধরনের বৈষম্যকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা হতে দিবেনা এ জাতি।