নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর বনানী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই অবাধে পরিচালিত হচ্ছে অবৈধ স্পা ও শিশা বারসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের কারবার। আর এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন থানার কতিপয় অসাধু পুলিশ সদস্য। অভিযোগ উঠেছে, বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) এ কে এম মঈন উদ্দিন মোটা অংকের মাসিক মাসোহারার বিনিময়ে বিধি অনুযায়ী অনুমোদনহীন অবৈধ স্পা ও শিশা বার পরিচালনায় সর্বাত্বক সহযোগীতা করছেন। এতে স্পা ও শিশা বার ব্যবসার আড়ালে মাদক বাণিজ্য ও অসামজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে অভিজাত এ এলাকার তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ নানা বয়সী মানুষ। টাকা উদ্ধার ও জমি সংক্রান্ত বিষযগুলো পুলিশ সদর দপ্তর এর কঠোর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও মামলার ভয় দেখিয়ে থানায় আটকে রেখে লোকজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসারি হয়েও অনৈতিক সুবিধা পেতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভোল পাল্টে চাকরি রক্ষার্থে নিজেকে এখন বিএনপি’র কাণ্ডারি বলেও দাবি করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনমনে চরম উদ্বেগ ও নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানীতে গড়ে ওঠা বৈধ স্পা ও শিশা বারের আড়ালে অবাধে চলছে মাদক বেচাকেনা, অসামাজিক কার্যকলাপ। আর এসব অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার নেপথ্যে থানার কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার অর্থ আদায়ের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া কড়াইল বস্তি ঘিরে মাদক কারবারিদের আনাগোনাও কয়েকগুণ বেড়েছে। সন্ধ্যা বা দিনের বেলায় কড়াইল বস্তির স্পটেগুলোতে মাদক বেচাকেনা চলছে হরহামেশা। এতে বস্তি এলাকার আশপাশের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করার অভিয়োগও রয়েছে ওই পুলিশ কর্মকর্তাসহ থানার আরও বেশকিছু সদস্যের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভালো পোস্টিং থাকলেও দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনৈতিক সুবিধা আদায়ে রাতারাতি ভোল পাল্টে বিএনপি’র কাণ্ডারি বনে যাওয়ার অভিয়োগ পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) এ কে এম মঈন উদ্দীন বলেন, আমি এসব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত, এ তথ্য কে বা কারা দিয়েছে, তার নাম-পরিচয় বা মোবাইল নম্বর আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, যা পারেন পত্রিকায় ছাপিয়ে দিন, আপনার নাম-পদবী ও অফিসের ঠিকানাটা দিন।
এদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সুত্র জানায়, বনানী ‘৩৬০ ডিগ্রি সিসা লাউঞ্জে’ ছাড়াও কিউডিএস, ৩২ ডিগ্রী, সেলসিয়াস, আরগিল লাউঞ্জ, এস্কেটিক লাউঞ্জ নামে কয়েকটি অবৈধ্য শিশা বারের স্পট রয়েছে। রাজধানীতে শিশা বারের আড়ালে হরহামেশা চলছে ভয়ংকর মাদক সেবন। মদ, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবহার হয় এসব বারে। ধনীর দুলাল-দুলালিরা রাত গভীর হলেই বিনোদনের জন্য এসব শিশা বারে ভিড় করে। সেখানে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মাদক কারবারি বলেন, বনানীতে গড়ে ওঠা ‘৩৬০ ডিগ্রি শিশা লাউঞ্জে’ রাহাত হোসেন রাব্বী নামের ইন্টারনেট ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কর্মকর্তা এ কে এম মঈন উদ্দিনের ভাগ্য খুলে যায়। প্রভাব খাটিয়ে বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) এ কে এম মঈন উদ্দিন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর সবগেুলো অবৈধ শিশা বারগুলোতে মাসিক মাসোয়ারার রেট দিগুণ করে দেয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি শিশা বার থেকে মাসে তিন থেকে চার লাখ ঘুষ নেন তিনি।
শিশা বার সুত্রগুলা জানিয়েছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে মঈন উদ্দিন মাসিক মাসোহারার টাকাগুলো আদায় করে নিচ্ছেন। বনানীতে রয়েছে কয়েকটি স্পা সার্ভিস। সেগুলো হল- আলোরী স্পা প্রিমিয়াম, স্পা সারিনি ও থাই ম্যাসেজ, হ্যাপি হাওয়ার স্পা, বনানী স্পা, ব্লিস স্পা বনানী, ঢাকা বডি কুইন স্পা, সার্ভিস এন্ড বডি ম্যাসেজ স্পা, গুলশান রোজ স্পা, জি স্পা বনানী সিগ্নেচার ওয়ান ওয়ে থাই স্পা, স্পা এন্ড স্পা গুলোতে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। সবগুলো স্পা’র নেই কোন অনুমোদন। এ কে এম মঈন উদ্দীন মাসিক ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা হারে মাসোহারা নিয়ে অসামাজিক কার্যক্রম চালনোর অনুমোদ বা সহোযোগীতা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বনানীর একাধিক স্পা সেন্টার ও শিশা বার ব্যবহার করে একটি মাদকের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। এ অবৈধ ব্যবসায় অল্প বয়সী তরুণীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)’র সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলামকে মানবপাচার অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তারের পর ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইজিপিকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। অভিয়োগ পাওয়া গেছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এ কে এম মঈন উদ্দীন তাকে ছেড়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের কথা অমান্য করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৩ নভেম্বর এ বিষয়ে তাকে আদালতে তলব করা হলে ঘটনা স্বীকার করে লিখিত ও মৌখিকভাবে আদালতে ক্ষমা চান ওসি মো. রাসেল সরোয়ার।
এসব অসাধু পুলিশ সদস্যরা মামলাবাণিজ্য, বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে খারাপ আচরণ, হুমকি-ধামকি দিয়ে টাকা আদায়সহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখিয়ে থানায় আটকে রেখে নিরীহ লোকজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত অপসারণ করা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দেন স্থানীয়রা।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, পুলিশে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি’র ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
