শিরোনাম

6/recent/ticker-posts

ফিরে দেখা ২০২৪: দেশের শুরু থেকে শেষ


দেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস।

কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। সক্রিয়ভাবেযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ডান ও বামের কোনো ভেদাভেদ ছিল না, গণঅভ্যুত্থানে সবাই ছিলেন এক দাবিতে, সেটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।

শুধু তাই নয়, ছাত্র আন্দোলনে পুলিশসহ বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন মুক্তিকামী বহু তরুণ-তরুণী। এই নৃশংসতা গা শিউরে ওঠার মতো ভয়াবহ! দীর্ঘ এই লাশের মিছিলের মধ্য বেশ কিছু মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।

শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে মানুষের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল আগেই। ক্ষোভের সেই বারুদে স্ফূলিঙ্গের মতো কাজ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা (১৫ জুলাই) এবং পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শহীদ হওয়া (১৬ জুলাই)। আবু সাঈদকে গুলি করার ভিডিও চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।

আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল গুলি করে। কিন্তু মানুষ বুক পেতে দিয়েছেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিয়নশিল্পী, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিক—সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার আর টিকতে পারেনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে লাশের মিছিলের সামিল হয়েছিলেন যারা-

আবু সাঈদ
কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ, মহিমান্বিত। আবু সাঈদের মৃত্যু জাতিকে দিয়েছে নতুন প্রাণ। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সাঈদ। তিনি এই আন্দোলনের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে পুলিশ সদস্যের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করে।

১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের সবাই সরে গেলেও আবু সাঈদ হাতে একটি লাঠি নিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। এই অবস্থায় পুলিশ খুব কাছ থেকে থেকে তার ওপর ছররা গুলি ছোড়ে। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। তারপরও অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ, দাঁড়িয়েই ছিলেন। একপর্যায়ে কয়েকটি গুলি খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মীর মুগ্ধ
জমজ দুই ভাই, স্নিগ্ধ মুগ্ধ। আইডেন্টিকাল টুইন তারা। একই চেহারা তাদের, একই মায়ের উদরে একসাথেই বড় হয়েছেন তারা। ছোটবেলা থেকেই একসাথে খাওয়া ঘুম, পড়াশোনা, সবকিছুই। তবে স্নিগ্ধ বেঁচে থাকলেও না-ফেরার দেশে মুগ্ধ। ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিয়েছে এই উদীয়মান তরুণের জীবন। এই মৃত্যুর ঘটনা কাঁদিয়েছে গোটা দেশকে। শুধু দেশই নয়, জেনেছে বিশ্বও।
বাংলাদেশ ইউভার্সির্টি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র ছিলেন মুগ্ধ মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন। সেই ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। মুগ্ধর কণ্ঠের ‘পানি লাগবে, পানি?’ এই বাক্য কানে বেজেছে দেশের কোটি মানুষের।

কিশোর তাহমিদ ভূঁইয়া
কিশোর তাহমিদের স্বপ্ন ছিল সেরা ক্রিকেটার হবে। বিশ্ব জয় করবে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মুহূর্তেই ঝরে গেল কচি প্রাণ। নিভে গেল জীবন প্রদীপ। অধরাই থেকে গেল তাহমিদের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন।

শহীদ তাহমিদ ভূঁইয়া (১৫) নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের নন্দীপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার ছেলে। নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের নবম শ্রেণির ছাত্র। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড় ছিল সে। ১৮ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নরসিংদী শহরের জেলখানার মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছিলো। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মাঝখানে পড়ে তাহমিদ। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তার বুক। ঘটনাস্থলেই মারা যায় তাহমিদ।

মুক্তির নেশায় নেশাতুর ফারহান ফাইয়াজ
‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ইন্ট্রোতে রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ ইংরেজিতে এ কথা লিখেছিলেন।

ফারহান কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে নেমে আর ঘরে ফিরতে পারেনি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ফারহান ফাইয়াজ নিহত হন।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার পর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল। সে সময় আহত হন ফারহান ফাইয়াজ। সেখান থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। বুলেটে তার শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল।

শিশু রিয়া গোপ
২০২৪ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। ১৯ জুলাই, দুপুরের খাবারের পর রিয়া খেলতে ছাদে যান। বাড়ির নিচে তখন পরিস্থিতি থমথমে ছিল; ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। গোলাগুলির শব্দ শুনে রিয়াকে নিরাপদে আনার জন্য তার পিতা দীপক কুমার গোপ ছাদে যান। এই সময় পুলিশের গুলিতে রিয়ার মাথার পেছনে আঘাত লাগে।

আহত অবস্থায় রিয়াকে প্রথমে স্থানীয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে অস্ত্রোপচার করা হয়। ডাক্তাররা রিয়াকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ICU) রাখেন এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উন্নতি আশা করেন। ২১ ও ২২ জুলাই রিয়ার শারীরিক কিছু নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেলেও ২৪ জুলাই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ‘গানশট ইনজুরি’। শিশু রিয়ার এমন মৃত্যৃ বিশ্বকে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল।

ইমাম হাসান ভূঁইয়া
‘পুলিশের ছেলে পুলিশেরই গুলিতে মরল, আমার স্বামী এই প্রতিদান পাইল? আমার ছেলেরে কতগুলা গুলি দিছে, ছেলে তো চোর-সন্ত্রাসী ছিল না। যে মারল, তার একটুও মায়া লাগে নাই? মারতে কয়টা গুলি লাগে?...আমি সঠিক বিচারটা চাই’—এসব কথা গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ১৯ বছর বয়সী ইমাম হাসান ভূঁইয়া তাইমের মা পারভীন আক্তারের। তার বুকফাঁটা গগনবিদারী আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠছিল চারপাশ। নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল শহরে।

রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে ইমাম হাসান। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী–সেতুর কাছে মারা যান ইমাম হাসান।

শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন
‘এ-কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,/শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?/হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং/সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং’—কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ এই কবিতা লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বর্বোরচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। চব্বিশে কবি বেঁচে থাকলে তার কবিতায় কতটুকু শোক ঝরত, বলার অপেক্ষা রাখে না।

পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে একজনকে টেনে নিচে ফেলা হলো। তিনি সাঁজোয়া যানের চাকার কাছে সড়কে পড়ে থাকেন। এরপর পুলিশের এক সদস্য সাঁজোয়া যান থেকে নিচে নামেন। এক হাত ধরে তাকে টেনে আরেকটু দূরে সড়কে ফেলে রাখেন। এখানেই শেষ নয়, পরে কয়েকজন পুলিশ মিলে তাকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে ঠেলে অপর পাশে ফেলে দেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে গত ১৮ জুলাই ঘটনাটি ঘটে। বর্বোরচিত এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন নামে ওই যুবক রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। বাসা সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়। তাকে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা ইয়ামিন নামেই ডাকতেন।

শহীদ নাফিস
এক পাশে শূন্যে ঝুলছে দেশের পতাকা মোড়ানো মাথা, অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ নিথর পা দুটো। একজন রিকশাচালক প্যাডেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেহটি। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দেখে যে কারোর পক্ষেই চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয় এ ছবিটি। এতে যার দেহ পরে থাকতে দেখা যায় তার নাম নাফিস। বয়স মাত্র ১৭ বছর। সবেমাত্র বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছেন যুকটি।

জানা যায়, ৪ আগস্ট সকালে নাফিস শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটে মুভমেন্টে যোগ দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে সর্বশেষ তার মাকে কল দিয়ে জানায় সে নিরাপদে আছে। মা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলে। এরপর সময় গড়াতে থাকে, নাফিসের আর কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না তার মা। মোবাইলেও কোনোভাবে সংযোগ করতে পারছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ তার বাবা বের হয় ছেলের খোঁজে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল টু হাসপাতাল খোঁজাখুজি করে কোথাও ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাত বারোটায় ফিরে যান বাসায়। এরমধ্যে নাফিসের সেই হৃদয়বিদারক ছবি ফেসবুক ভাইরাল হয়ে যায়। বড় ভাই সেই ছবি দেখায় বাবাকে। সেখান থেকে তারা শনাক্ত করতে পারে নাফিসকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাফিসের বাবা মানবজমিন পত্রিকার অফিসে ছুটে যান সেই ছবিটির ফটোগ্রাফারের কাছে৷ মানবজমিনের অফিসে থাকা অবস্থায় তার শালা (মানে নাফিসের মামা) কল দিয়ে জানায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে পাওয়া গেছে নাফিসের লাশ।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যা
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণ-অভুত্থানের সময় সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডকে ‘জুলাই গণহত্যা’ বলা হয়। বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল ও ব্যাপক গণ-অসন্তোষের জের ধরে এই দমন অভিযান পরিচালনা করে তৎকালীন সরকার, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জুলাই বিপ্লবে অন্তত ১ হাজার ৪২৩ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম। গেল ২১ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে তিনি আরও বলেন, শহীদ এবং আহতদের সংখ্যায় আরও কিছু সংযোজন-বিভাজন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে খুব শিগগিরই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। এত প্রাণহানি সত্ত্বেও হাসিনা সরকার এই গণহত্যার দায় অস্বীকার করে এবং সহিংসতার জন্য অন্যান্য কারণকে দায়ী করে।

একদফা দাবিতে আন্দোলন
৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনটির সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে।

পরে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন নাহিদ। তিনি বলেন, সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, শিল্পী গোষ্ঠী, শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু সারা দেশের মানুষ সমর্থন যোগান। একটি সংবাদ সম্মেলনে দেশের সাবেক সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় না করানোর আহ্বান জানান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে অসহযোগ কর্মসূচি ঠেকাতে ৪ আগস্ট তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বলা হয়, সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেইসঙ্গে অনির্দিষ্টকালের কারফিউও বহাল রাখা হয়।

এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’র ঘোষণা দেন। কিছু সময় পর সেই কর্মসূচি ৫ আগস্টের জন্য ঘোষণা দেন সমন্বয়করা। সারাদেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং গণ-অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন। অন্যদিকে কঠোর হাতে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করতে ৪ আগস্ট দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৪ আগস্ট দুপুর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ
৫ আগস্ট সকালেও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। গুলিতে সেদিনও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। তবে দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণের ঘোষণা দেন। তখনই রাজধানীর বুকে ছাত্র-জনতার ঢল নামে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া লাখো মানুষের সমাবেশ বেলা আড়াইটার দিকে যাত্রা করে গণভবনের দিকে। এরপর জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

সেনাপ্রধানের ভাষণের পরই উচ্ছ্বসিত ছাত্র-জনতার মিছিলে মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘কী হয়েছে কী হয়েছে, শেখ হাসিনা পালাইছে’। ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করল। যার জন্য শেষদিন পর্যন্ত সময়কে ‘৩৬ জুলাই’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে ছাত্র-জনতা।